তুলসিডাঙ্গার দুই রত্ন: এক পরিবারে দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম তুলসিডাঙ্গা। অথচ এই গ্রাম থেকেই জন্ম নিয়েছে এমন এক গর্বিত অধ্যায়, যা এখন সারা কলারোয়া তথা সাতক্ষীরা জেলাকে আলোয় উদ্ভাসিত করেছে। কলারোয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের তুলশীডাঙ্গার (গ্রামের বাড়ি কামারালি) এক শিক্ষিত পরিবার থেকে উঠে আসা দুই ভাই আজ দেশের চিকিৎসা খাতে তাদের মেধা, পরিশ্রম ও দক্ষতা দিয়ে রেখেছেন উজ্জ্বল ছাপ।
তাঁদের এই অর্জনের পেছনে রয়েছেন দুই জন আলোকবর্তিকা অভিভাবক—পিতা অধ্যাপক মোঃ আবু বকর সিদ্দিক, কলারোয়া সরকারি কলেজের একজন সনামধন্য শিক্ষক ও সাবেক অধ্যক্ষ; এবং মাতা সুলতানা কামরুন্নেছা, কলারোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। শিক্ষক পরিবারে জন্ম নেওয়া দুই ছেলে আজ দেশসেবা করছেন দুইটি ভিন্ন অথচ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা শাখায়।
ডা. মুহাম্মদ নাঈম সিদ্দিকী — চক্ষু চিকিৎসায় দক্ষ ও মানবিক কনসালট্যান্ট
বড় ছেলে ডা. মুহাঃ নাঈম সিদ্দিকী শিক্ষাজীবন শুরু করেন কলারোয়া জি.কে.এম.কে পাইলট হাই স্কুলে, পরবর্তীতে কলারোয়া সরকারি কলেজে পড়াশোনা করেন। নিজের কঠোর অধ্যবসায়ে ভর্তি হন সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে, যেখান থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
চোখের চিকিৎসা বিষয়ে আগ্রহ এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে তিনি ভর্তি হন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি হাসপাতাল) এ। সেখান থেকে চক্ষু বিভাগে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে তিনি গোপালগঞ্জ চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।
তিনি শুধু চিকিৎসক নন, একজন মানবিক ও দায়িত্ববান মানুষ হিসেবেও এলাকায় পরিচিত। চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়ে বহু মানুষকে আবার নতুন জীবন উপহার দিচ্ছেন তিনি।
ডা. তানভীর সিদ্দিকী — কলারোয়ার প্রথম নিউরো সার্জন, ব্রেইন ও স্পাইন সার্জারির পথিকৃৎ
ছোট ভাই ডা. তানবীর সিদ্দিকী একই স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করে ভর্তি হন দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করার পর, নিজের আগ্রহ ও সাহসিকতাকে পুঁজি করে পা রাখেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং শাখা—নিউরো সার্জারি (মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল সার্জারি)।
তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল) থেকে এমএস (ব্রেইন ও স্পাইন সার্জারি) ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি কলারোয়া ও আশেপাশের অঞ্চলের প্রথম চিকিৎসক, যিনি এই উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন।
বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে কর্মরত আছেন। প্রতিদিন তিনি বিভিন্ন জটিল ব্রেইন ও স্পাইন অপারেশন করে বহু রোগীকে নতুন জীবন ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
শিক্ষক পরিবার, শিক্ষা-ভিত্তিক স্বপ্ন, এবং সমাজে অবদান
এই অসাধারণ সাফল্যের পেছনে রয়েছে একটি সুসংগঠিত ও মূল্যবোধসম্পন্ন পরিবার। পিতা অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক তাঁর কর্মজীবনে বহু ছাত্রকে গড়ে তুলেছেন। শুধু নিজের সন্তান নয়, তাঁর শিক্ষার্থীরাও তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। মা সুলতানা কামরুন্নেছা ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শিখিয়েছেন দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করার শিক্ষা।
অধ্যাপক সিদ্দিক বলেন, “আমি সবসময় আমার ছেলেদের বলতাম, জীবনের সেরা অর্জন হলো মানুষের উপকারে আসা। আজ তারা সেই পথেই হাঁটছে।”
মা কামরুন্নেছা বলেন, “গ্রামের একজন শিক্ষিকা হিসেবে আমি সবসময় স্বপ্ন দেখতাম আমার সন্তানরা শিক্ষিত হবে, সৎ থাকবে, এবং মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আজ সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।”
তুলসিডাঙ্গা থেকে ঢাকায়, গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায়—এক অনুপ্রেরণার গল্প
এই দুই ভাইয়ের সাফল্য শুধু তাঁদের পরিবারের নয়, পুরো তুলসিডাঙ্গা, কলারোয়া ও সাতক্ষীরাবাসীর গর্ব। তাদের পথচলা তরুণদের শেখায়—স্বপ্ন দেখো, পরিশ্রম করো, এবং কখনো হাল ছেড়ো না। শিক্ষিত অভিভাবক, উপযুক্ত দিকনির্দেশনা, ও নিজের অদম্য চেষ্টা—এই তিনটি উপাদান থাকলে গ্রামের ছেলেও শহরের নেতৃত্ব দিতে পারে।
তাঁদের এই পথচলা যেন আগামীর প্রজন্মের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হয়ে ওঠে।
